প্রবন্ধ রচনা । বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ। বিজ্ঞান ও কুসংস্কার

প্রবন্ধ রচনা । বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ।  বিজ্ঞান ও কুসংস্কার

প্রবন্ধ রচনা । বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ।  বিজ্ঞান ও কুসংস্কার



'যে জাতি জীবনহারা অচল অসাড় পদে পদে বাঁধে তারে জীর্ণ লোকাচার।' -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ভূমিকা:- মানুষ বিধাতার সৃষ্টিশালার শ্রেষ্ঠ উপহার। সৃষ্টিকালে বিধাতা মানুষকে দিয়েছেন যুক্তিবাদী জটিল মস্তিষ্ক। সেই মস্তিষ্কের বলেই মানুষ অরণ্য-সংকুল পৃথিবীকে সুখের অমরাবতীতে পরিণত করেছে। মানুষেরই শাসনে ধরিত্রী জননী হয়ে উঠেছে 'সুন্দর কুসুমিত মনোহরা।' মানুষের যুক্তিবাদী মস্তিষ্কের কষ্টি পাথরে যাচাই হয়েছে প্রকৃতির রহস্যময়তা, সৃষ্টিতত্ত্বের গূঢ় ইতিহাস। এই পথ ধরেই মানুষের জীবনে নেমে এসেছে বিজ্ঞান। এই বিজ্ঞানের হাত ধরে আমরা পৌঁছে গেছি সভ্যতার স্বর্ণশিখরে। জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে আজ বিজ্ঞানের অবাধ বিচরণ। ভাবতে অবাক লাগে এই কল্লোলিনী তিলোত্তমা সভ্যতায় বাস করে আমরা আজও নানা কুসংস্কারের দাসত্ব করে চলেছি। ধর্মীয় সংকীর্ণতা অথবা সামাজিক কু-প্রথা আজও আমাদের সমাজের দূরপণেয় ক্ষত। আমরা বিজ্ঞাননির্ভর হয়েছি সত্য কিন্তু বিজ্ঞানমনস্ক হতে পারিনি।


বিজ্ঞান কিঃ- বিজ্ঞান শব্দের অর্থ বিশেষরূপ জ্ঞান। যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করে পরীক্ষালব্ধ প্রমাণের মধ্য দিয়ে যে যথার্থ জ্ঞান লাভ করা যায় তাই হল বিজ্ঞান। এখানে নেই মিথ্যা ভণ্ডামি, নেই পক্ষপাতিত্ব, আছে শুধু সত্যের দ্বার উদঘাটনের প্রয়াস। এই বিজ্ঞানই আমাদের অজানার জগৎ থেকে জানার জগতে পৌঁছে দেয়, আমাদের মনের অন্ধকার দূর করে আলোর বন্যা বইয়ে দেয়। তাই বিজ্ঞানের অর্থ হল 'বিশেষ জ্ঞান।'




কুসংস্কার কি:- মানুষের চিরঅনুসন্ধিৎসু মনের বিপরীত দিকে যে বিষয়টি বর্তমান তা হল কুসংস্কার। যা আজও মানুষকে ছায়ার মত অনুসরণ করছে। যে সংস্কারগুলি সমাজজীবনে চলার পথে ক্ষতিসাধন করে, যেগুলি পরীক্ষামূলক ভাবে প্রমাণিত হয়নি, যা আমাদের মনে বংশ-পরম্পরায় নির্বিবাদে বিচরণ করে, যার মূল কাঠামোটি অন্ধবিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত, তাই হল কুসংস্কার। বলাবাহুল্য, সত্যানুসন্ধানী বিজ্ঞানের সঙ্গে এর বিরোধ চিরকালের। বিজ্ঞান যদি আলো হয়, কুসংস্কার হল অন্ধকার। বিজ্ঞান যদি মরূদ্যান হয়, কুসংস্কার হল ঊষর মরূভূমি। বিজ্ঞান প্রগতিমুখী কিন্তু কুসংস্কার যে মানব জীবনে চলার পথকে স্তব্ধ করে দেয় সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।




সমাজে নানা ধরণের কুসংস্কার ও বিজ্ঞান:- আমাদের সমাজ সংসার আজও নানা কুসংস্কারের অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারেনি। হাঁচি, টিকটিকির বাধায় আজও অনেকের শুভযাত্রা মাটি হয়। বারবেলায় শুভ কাজে বেরোনোয় বাধা, ধূমকেতুর আবির্ভাবে অমঙ্গলের আশঙ্কা, 'এক শালিক দেখা জোড়া ভালো নয়' মানসিক অশান্তি, কুকুর কাঁদলে বিপদের সম্ভাবনা, চালের উপর শকুন বসলে অমঙ্গল, বামে সাপ দর্শনে অমঙ্গল, পিছু ডাকে অকল্যাণ, গ্রহণের সময় রান্না খাবার খেতে নেই, মেয়েদের জোড়া কলা খেতে নেই, মাথায় দুটি ঘূর্ণি থাকলে দুবার বিয়ে হয়, পা ছড়িয়ে খেলে দূরে বিয়ে হয় প্রভৃতি কুসংস্কার আজও সমাজের বুকে দীর্ঘ শিকড় সেঁদিয়ে বসে আছে। এখনও অপদেবতা কিংবা ভূত-প্রেতের নামে ওঝা ডেকে মন্ত্রপাঠ ও তুকতাক চলে। দেবতার চরণামৃত খাইয়ে রোগ নিরাময়ের ভ্রান্ত বিশ্বাসে আজও অনেকে প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হয়। বেশ কয়েকবছর আগে কোন এক ধর্মাবতারের মৃতদেহ ধোয়া জল খেয়ে শত শত ভক্তের দল অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের গলায় আজও তাবিজ কবচ বাঁধা থাকে। গ্রহের বিরূপ দৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আজও অনেকে নানা ধরণের মন্ত্রপূত আংটি ধারণ করেন। কয়েকবছর আগে গণেশ ঠাকুরের দুধ খাওয়ানোকে কেন্দ্র করে এক লজ্জাকর ঘটনা ঘটেছিল। সারা ভারতে সেদিন কয়েক লক্ষ লিটার দুধ নষ্ট হল। বাস্তুধর্মের প্রভাবে পাথরের প্রতিমা দুধ খায় অথচ মানুষের অন্ধবিশ্বাস তা মানতে চায় না।

এই সব কুসংস্কারের পিছনে কোন বৈজ্ঞানিক কার্যকারণ সম্পর্ক নেই। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত কিছু কিছু মানুষও অন্ধবিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে কুসংস্কারের শিকার হয়ে পড়েন। আসলে প্রকৃত শিক্ষার অভাবই এই সমস্ত সংস্কারকে পোষণ করে পল্লবিত করে তুলে। চেতনাহীন মানুষ ভয়ের শিকার হয়ে এগুলি বিশ্বাস করে। এই কুসংস্কারের উৎস সম্বন্ধে আইনস্টাইন বলেছেন,




"It is this undefined source of fear and hope which is the genius of irrational superstition."




কুসংস্কারের কুফল:- বিজ্ঞান চেতনার অভাবে এখনও চলছে জাতপাতের লড়াই। ধর্ম-আফিমের নেশায় মত্ত হয়ে মন্দির মসজিদ ধ্বংস করছে। সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতার বিষবাষ্পে চারদিক আজ কলুষিত। ডাইনি অপবাদ দিয়ে অসহায় স্ত্রীলোককে আজও পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। বর্ণভেদের সুযোগ নিয়ে তথাকথিত উচ্চবর্ণীদের অহংকার একশ্রেণীর মানুষকে উচ্ছৃঙ্খল করে তুলেছে। দেবমন্দিরে পাণ্ডাদের অত্যাগর, তীর্থক্ষেত্রে ধর্মব্যবসায়ীদের অর্থলিপ্সার শিকার হচ্ছে অসংখ্য মানুষ।

কুসংস্কার দূরীকরণের উপায় ও বিজ্ঞান:- সমাজের এই অন্ধবিশ্বাসের ও কুসংস্কারের অচলায়তনকে ভেঙে ফেলা সহজ কথা নয়। মানুষের মনে বিজ্ঞানমনস্কতা না জাগলো কুসংস্কারের জগদ্দল পাথরকে সরানো যাবে না। মানুষের মধ্যে তাই গড়ে তুলতে হবে বিজ্ঞান চেতনা। সক্রিয় যুক্তিবাদী মনে কখনও সংস্কারের শ্যাওলা জমে না। ইংরাজিতে একটি প্রবাদ আছে- A rolling stone gathers no

শিক্ষার অভাবই মানুষকে কুসংস্কারমুখী করে তুলেছে। সেজন্য সকলকে শিক্ষার পাদপ্রদীপের আলোয় আনার ব্যবস্থা করলে কুসংস্কার দূর হবে। সর্বোপরি গণমাধ্যমগুলিকে বিজ্ঞান চেতনা প্রসারে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে।

আশার কথা সারা পৃথিবী জুড়ে কুসংস্কার দূরীকরণে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদকে কাজে লাগানো হয়েছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে মানুষের মনের অন্ধবিশ্বাস কিছুটা লাঘব হয়েছে। সম্প্রতি বিজ্ঞান জাঠা ও বিজ্ঞান মঞ্চ গ্রামে-গঞ্জে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে বিজ্ঞানের যুক্তিনিষ্ঠ পথকে প্রতিষ্ঠিত করে চলেছে।

উপসংহার:- বিজ্ঞান মানুষের মন থেকে ভ্রান্ত ধারণাকে দূর করে তার মোহমুক্তি ঘটায়, তাকে মিলিত করে যুক্তিবাদের পতাকাতলে। ধর্মমোহ বর্তমান ভারতবর্ষে জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। মোহগ্রস্ত মানুষ সত্যের পথ থেকে সরে গিয়ে কুসংস্কারের চোরবালিতে পা দিয়েছে। ধর্ম হল শুদ্ধ জীবনযাপনের সাধনব্রত। কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাস সেই সাধনার ক্ষেত্রকে করেছে কলুষিত। দৃষ্টান্তের সাহায্যে মন থেকে ধারণাকে, সমাজ জীবন থেকে কুসংস্কারকে দূর করে দিতে হবে। কবি নজরুলও অনুরূপ মত পোষণ করেছিলেন।

"মেনে শত বাধা টিকটিকি হাঁচি

টিকি দাড়ি নিয়ে আজো বেঁচে আছি

বাঁচিতে বাঁচিতে প্রায় মরিয়াছি,

এবার সব্যসাচী

যা হোক একটা তুলে দাও হাতে,

একবার মরে বাঁচি।"

আর সেটাই হচ্ছে বিজ্ঞান যা মানুষকে কুসংস্কারের হাত থেকে বাঁচাতে পারে, মানুষের ক্লেদ-পঙ্কিল মনের জমিতে ফোটাতে পারবে মানবতার শতদল। জীর্ণ লোকাচারের জঞ্জাল সত্যলোকের পরশে দূরীভূত হোক। বিজ্ঞাননির্ভর সভ্যতায় দাঁড়িয়ে কবি কণ্ঠের অনুসরণে আমাদের প্রার্থনা-

"এ দুর্ভাগা দেশ হতে হে মঙ্গলময়

দূর করে দাও তুমি সর্ব তুচ্ছ ভয়।"

0/Post a Comment/Comments