Bangla Note: বাংলা ছোট গল্প রচনায় রবীন্দ্রনাথের অবদান
উত্তর- বাংলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক উপন্যাস রচনার কৃতিত্ব যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের, অনুরূপভাবে বাংলা ছোটগল্পের সার্থক সূচনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে। এই সার্থকতা এতোটা উচ্চমানের যে, কোনো কোনো সাহিত্যবিশ্লেষক মনে করেন, শুধু ছোটগল্প সৃষ্টির জন্য রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যিক হিসেবে বিশ্বজনীন খ্যাতি ও স্বীকৃতি লাভের যোগ্যতা রাখেন।
রবীন্দ্রনাথ মূলত কবি এবং তার অধিকাংশ কবিতাই লিরিকধর্মী। এই গীতিময়তা তার ছোটগল্পেও প্রবলভাবে উপস্থিত। প্রকৃতির সঙ্গে পরিপূর্ণ একাত্মবোধ, জীবনের আপাততুচ্ছ ব্যাপারকেও পরম রমণীয় ও অপূর্ব রহস্যময় হিসেবে অনুভব করা, এসবের প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস, নিজেকে একান্তভাবে নির্লিপ্ত করে দিয়ে একমনে জীবনকে প্রকৃতির সব অভিব্যক্তির মধ্যে উপভোগ করা’এসবই রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পগুলোতে অপূর্ব রসে অভিষিক্ত হয়ে উঠেছে।
রবীন্দ্রনাথ ছোটগল্প লেখা শুরু করেন ১২৯৮ বাংলা সনে। তখন থেকে ১৩১০ সনের মধ্যে তার বেশিরভাগ গল্প রচিত। তার একটি বিখ্যাত গল্প ‘পোস্টমাস্টার’ ১২৯৮ সালে লেখা। এর কিছুদিন আগে থেকে তিনি জমিদারি দেখাশোনার ভার নিয়েছেন। তার দিন কাটছে পদ্মার ওপরে নৌকায় ভেসে ভেসে শাহজাদপুরে, শিলাইদহে। আনন্দময় বৈচিত্র্যে ভরপুর এ সময়ের জীবনযাত্রা। বাংলাদেশের একটি নির্জন প্রান্ত; তার নদী তীর, উন্মুক্ত আকাশ, বালুর চর, অবারিত মাঠ, ছায়া-সুনিবিড় গ্রামে সহজ অনাড়ম্বর পল্লীজীবন, অভাবক্লিষ্ট অথচ শান্তসহিষ্ণু গ্রামবাসী, কবি বিমুগ্ধ বিস্ময়ে, পুলকে শ্রদ্ধায় ও বিশ্বাসে এসবের অপরিসীম সৌন্দর্য আকণ্ঠ পান করছেন। ধীরে ধীরে বাংলাদেশের পল্লীজীবনের সুখ-দুঃখের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ পরিচয় শুরু হয়। পল্লীজীবনের নানা বেদনা আর আনন্দ যখন তার মনকে অধিকার করে বসলো, তখন তার ভাব ও কল্পনার মধ্যে আপনাআপনি বিভিন্ন গল্প রূপ পেতে শুরু করলো।
১৮৯৪-এর ২৭ জুন শিলাইদহ থেকে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেনÑ ‘আজকাল মনে হচ্ছে, যদি আমি আর কিছুই না করে ছোট ছোট গল্প লিখতে বসি তাহলে কতকটা মনের সুখে থাকি এবং কৃতকার্য হতে পারলে পাঁচজন পাঠকেরও মনের সুখের কারণ হওয়া যায়। গল্প লিখবার একটা সুখ এই, যাদের কথা লিখব তারা আমার দিনরাত্রির অবসর একেবারে ভরে রেখে দেবে, আবার একলা মনের সঙ্গী হবে, বর্ষার সময় আমার বদ্ধঘরের সঙ্কীর্ণতা দূর করবে এবং রৌদ্রের সময় পদ্মা তীরের উজ্জ্বল দৃশ্যের মধ্যে আমার চোখের পরে বেড়িয়ে বেড়াবে।’এভাবে এ সময় তিনি ‘মেঘ ও রৌদ্র’-এর মতো একটি অসাধারণ ছোটগল্পের সৃষ্টি করলেন।
এভাবেই দু’বছর আগে (২৯ জুন, ১৮৯২) শাহজাদপুরের কুঠিতে একদিন গ্রামের পোস্টমাস্টারের আগমন উপলক্ষ করে ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পটির সৃষ্টি হলো। ‘সমাপ্তি’ গল্পের মৃন্ময়ী, ‘ছুটি’ গল্পের ফটিক এরাও এই সময়কার সৃষ্টি।
রবীন্দ্রনাথের একেবারে প্রথমদিককার গল্পগুলোর একটি হচ্ছে ‘পোস্টমাস্টার’। গল্পটি একান্তভাবে গীতধর্মী। একটি স্বজনহারা নিঃসহায় গ্রাম্য বালিকার স্নেহের জন্য ব্যাকুল হৃদয় আসন্ন বিচ্ছেদের আশঙ্কায় হতবিহ্বল। তারই সকরুণ অশ্রুসজল ছায়াপাত ঘটেছে গল্পটির মধ্যে।
রবীন্দ্রনাথের লেখা পোস্টমাস্টার এবং এ ধরনের গীতধর্মী গল্পগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কবির কল্পলোকের মানুষগুলো ঘটনার আবেষ্টনের বাইরের চতুর্দিকের জগতের সঙ্গে, প্রকৃতির ছায়া-আলো, গন্ধ-বর্ণ-ধ্বনি ও ছন্দের সঙ্গে একান্তভাবে মিশে যায়। সৃষ্টি করে একটা সুরের জগৎ। স্বজন থেকে দূরে, এক নিভৃত পল্লীতে দরিদ্র পোস্টমাস্টারের জীবন প্রথম প্রথম নির্বাসনতুল্য বলে মনে হতো। মাঝে মধ্যে একা একা ঘরে বসে তিনি একটি ‘স্নেহ পুত্তলি মানব মূর্তি’র সঙ্গ কামনা করতেন; নিজের ঘরের ছেলেমেয়ে, স্ত্রীর কথা তার মনে হয়। এই কামনাটুকু গল্পটিতে করুণ রসে সিক্ত হয়ে চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। এই গল্পটিতেই বিদায় যখন ঘনিয়ে এলো, রতন পোস্টমাস্টারের সামনে থেকে এক দৌড়ে পালিয়ে গেল। ভূতপূর্ব পোস্টমাস্টার ধীরে ধীরে নৌকার দিকে চললেন। ‘যখন নৌকায় উঠিলেন এবং নৌকা ছাড়িয়া দিল' বর্ষা বিস্ফোরিত নদী ধরণীর উচ্ছলিত অশ্রুরাশির মতো চারিদিকে ছলছল করিতে লাগল, তখন হৃদয়ের মধ্যে অত্যন্ত একটা বেদনা অনুভব করিতে লাগিলেন; একটা সামান্য বালিকার করুণ মুখচ্ছবি যেন এক বিশ্বব্যাপী বৃহৎ অব্যক্ত মর্মব্যথা প্রকাশ করিতে লাগিল। একবার নিতান্ত ইচ্ছা হইল ফিরিয়া যাই; জগতের ক্রোড়বিচ্যুত সেই অনাথিনীকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসি। কিন্তু তখন পালে বাতাস পাইয়াছে, বর্ষার স্রোত খরবেগে বহিতেছে, গ্রাম অতিক্রম করিয়া নদীকূলের শ্মশান দেখা দিয়াছে এবং নদী প্রবাহে ভাসমান পথিকের উদাস হৃদয়ে এই তত্ত্বের উদয় হইল, জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া ফল কী? পৃথিবীতে কে কাহার?’
‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পের শশীভূষণ আর গিরিবালা নিজেরাই শুধু কাঁদে না, পাঠকদেরও কাঁদায়। গল্পের শুরুতে বর্ণনা আছেÑ ‘আমরা যেখানে একটি ক্ষুদ্র জীবননাট্যের পট উত্তোলন করিলাম, সেখানে গ্রামে পথের ধারে একটি বাড়ি দেখা যাইতেছে। বাহিরের একটি মাত্র ঘর পাকা।… দেখা যাইতেছে, একটি যুবাপুরুষ খালি গায়ে তক্তপোষে বসিয়া বামহস্তে ক্ষণে ক্ষণে তালপাতার পাখা লইয়া গ্রীষ্ম এবং মশক দূর করিবার চেষ্টা করিতেছেন এবং দক্ষিণ হস্তে বই লইয়া পাঠে নিবিষ্ট আছেন। বাহিরে গ্রামের পথে একটি ডুরে-কাপড় পরা বালিকা আঁচলে গুটিকতক কালোজাম লইয়া একে একে নিঃশেষ করিতে করিতে উক্ত গারদ-দেওয়া জানালার সন্মুখ দিয়া বারংবার যাতায়াত করিতেছিল। মুখের ভাবে স্পষ্টই বোঝা যাইতেছিল, ভিতরে যে মানুষটি তক্তপোষে বসিয়া বই পড়িতেছে তাহার সহিত বালিকার ঘনিষ্ঠ পরিচয় আছে এবং কোনমতে সে তাহার মনোযোগ আকর্ষণপূর্বক তাহাকে নীরবে অবজ্ঞাভরে জানাইয়া যাইতে চাহে যে, সম্প্রতি কালোজাম খাইতে আমি অত্যন্ত ব্যস্ত আছি, তোমাকে আমি গ্রাহ্য মাত্র করি না।’
গিরিবালার বয়স ১০ এবং শশীভূষণ একটি সদ্য বিকশিত এমএবিএল। উভয়ে প্রতিবেশী। তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠা, বিশেষ করে ১০ বছরের বালিকার মন কেমন করা এ যুগে আমাদের কাছে অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। কিন্তু যখনকার গল্প, সে সময়ে মেয়েরা সাধারণত ৮/৯ বছর বয়সে শ্বশুরবাড়ি যেতো, ১০ বছর বয়সী তো রীতিমতো আইবুড়ি। গল্পের একেবারে শেষে এসে আমরা দেখি, মাঝে অনেক বছর পার হয়ে গেলেও শশীভূষণ আর গিরিবালা কেউ কাউকে ভোলেনি। তবে তাদের জীবন ছিল না কুসুমাস্তীর্ণ। দীর্ঘ বিচ্ছেদ শেষে দেখা হয়েছিল পরস্পরের। ‘অনেকক্ষণ পরে মৃদু শব্দে সচকিত হইয়া (শশীভূষণ) মুখ তুলিয়া দেখিলেন, তাহার সম্মুখে রূপার থালায় ফলমূল, মিষ্টান্ন রাখিয়া গিরিবালা অদূরে দাঁড়াইয়া নীরবে অপেক্ষা করিতেছিল। তিনি মস্তক তুলিতেই নিরাভরণা শুভ্রবসনা বিধবা বেশধারিণী গিরিবালা তাহাকে নতজানু হইয়া ভূমিষ্ট প্রণাম করিল। বিধবা উঠিয়া দাঁড়াইয়া যখন শীর্ণমুখ ম্লানবর্ণ ভগ্নশরীর শশীভূষণের দিকে সকরুণ স্নিগ্ধনেতে চাহিয়া দেখিল, তখন তাহার দুই চক্ষু ঝরিয়া, দুই কপোল বাহিয়া অশ্রু পড়িতে লাগিল। শশীভূষণ তাহাকে কুশল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে চেষ্টা করিলেন, কিন্তু ভাষা খুঁজিয়া পাইলেন না; নিরুদ্ধ অশ্রুবাষ্প তাহার বাক্যপথ সবলে অবরোধ করিল, কথা এবং অশ্রু উভয়েই নিরুপায়ভাবে হৃদয়ের মুখে কণ্ঠের দ্বারে বন্ধ হইয়া রহিল।…’
শশীভূষণ আর গিরিবালা চরিত্র আমাদের অচেনা নয়। চেনা লোকের দেখা ঘটনা কল্পনার মিশেল দিয়ে যে অধিকাংশ গল্প রচিত, এ কথা রবীন্দ্রনাথ নিজেই স্বীকার করেছেন বিভিন্ন লেখায়। ‘এই অজ্ঞাত ছোট মেয়েটির ইতিহাস আমার যেন অনেকটা পরিচিত হয়ে গেল।’ এই পরিচয় আমাদের উপহার দিল ‘সমাপ্তি’ নামের ছোটগল্প। কাবুলিওয়ালা গল্পটি বাস্তব নয়। তবে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, ‘মিনি আমার বড় মেয়ের আদর্শে রচিত’ ।
এই জীবন ঘনিষ্ঠতাই রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের প্রাণ। তাই আমরা গল্পগুলোর মধ্যে খুঁজে পাই আমাদেরই আনন্দ-বেদনার প্রতিফলন।
Post a Comment