Bangla Note : প্রশ্নঃ ছোট গল্পকার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৃতিত্বের পরিচয় দাও ।
Bangla Note : উত্তর- বাংলা সাহিত্যের দিকপাল তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (Manik Bandopadhyay)। বাংলা সাহিত্যে তাঁর স্বকীয়তা হল, কঠিন কঠোর বাস্তবের গভীর জীবনভাবনাকে তিনি সুদৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের সাথে উপস্থাপন করেছেন। ১৯০৮ সালের ১৯শে মে বিহারের সাঁওতাল পরগণার দুমকায় তাঁর জন্ম। তাঁর আসল নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। গায়ের রঙ কালো অথচ ফুটফুটে সুন্দর এই শিশুর আঁতুড়ঘরেই নামকরণ হয় কালোমাণিক।
শৈশবে তিনি (Manik Bandopadhyay) ভীষণ দুরন্ত এবং একই সঙ্গে হাসিখুশি ও নির্ভীক স্বভাবের অধিকারী ছিলেন। তিনি স্বভাবে একটু বেপরোয়াও ছিলেন। টাঙ্গাইলে থাকার সময়ে স্কুলে না গিয়ে তিনি একা একা মাঠে ঘুরে বেড়াতেন, বাঁশী বাজাতেন। তিনি নাকি খুব ভাল বাঁশী বাজাতে পারতেন। কখনও মাঝিদের সঙ্গে রাত কাটাতেন নৌকায়। কখনও সময় কাটাতেন ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ানের সঙ্গে। এর জন্য বাড়ীর বড়দের কাছে তিরস্কারও পেয়েছেন প্রচুর। কিন্তু এর ফলেই তিনি সমাজের খেটে খাওয়া মানুষের জীবনসংগ্রাম সম্বন্ধে গভীর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন, যার প্রতিফলন আমরা তাঁর সাহিত্যে পাই।
তাঁর (Manik Bandopadhyay) সাহিত্যজগতে আগমন নিতান্ত আকস্মিক। কলেজের বন্ধুদের সাথে তর্ক করে তখনকার দিনের সুবিখ্যাত বিচিত্রা পত্রিকায় প্রকাশের জন্য তিনি মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছদ্মনামের আড়ালে অতসীমামী নামে একটি ছোটোগল্প রচনা করে পাঠান। গল্পটি যথাসময়ে প্রকাশিত হলে পাঠক ও সমালোচক মহলের ভূয়সী প্রশংসা লাভ করে ও সাহিত্য সমাজে তিনি সাদরে গৃহীত হন। তার পর থেকে বিজ্ঞান সরস্বতীর পরিবর্তে সাহিত্য সরস্বতীই হয়ে ওঠেন তাঁর আরাধ্যা। তাঁর মাত্র ৪৮ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে তিনি বহু ছোটোগল্পরচনা করেন। তাঁর রচনাসম্ভারে রয়েছেঃ-
গল্পগ্রন্থঃ
১। অতসীমামী ও অন্যান্য গল্প ১৯৩৫ ১০। ফতিয় ১৯৪৭
২। প্রাগৈতিহাসিক ১৯৩৭ ১১। ছোটবড় ১৯৪৮
৩। মিহি ও মোটা কাহিনী ১৯৩৮ ১২। ছোট বকুলপুরের যাত্রী ১৯৪৯
৪। সরীসৃপ ১৯৩৯ ১৩। ফেরিওলা ১৯৫৩
৫। বৌ ১৯৪৩ ১৪। লাজুকলতা ১৯৫৪
৬। সমুদ্রের স্বাদ ১৯৪৩ ১৫। ছোটদের শ্রেষ্ঠ গল্প ১৯৫৮
৭। ভেজাল ১৯৪৪ ১৬। উত্তরকালের গল্প সংগ্রহ ১৯৬৩
৮। হলুদ পোড়া ১৯৪৫ ১৭। কিশোর বিচিত্রা ১৯৬৮
৯। পরিস্থিতি ১৯৪৬ ১৮। আজ কাল পরশুর গল্প ১৯৪৬
মানিক বন্দ্যপাধ্যায়ের (Manik Bandopadhyay) সাহিত্যসৃষ্টি বিশ্লেষণ করলে কতকগুলি বিশেষ দিক লক্ষ্য করা যায়। লেখক বাস্তব্বাদী দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনকে দেখেছেন ও নতুনভাবে তার বিশ্লেষণ করেছেন। কেবলমাত্র বাস্তবের হুবহু বর্ণনা নয়, বাস্তবের অন্তঃসারশূন্যতার তিনি তীব্র সমালোচনা করেছেন তাঁর সাহিত্যে। এস্থলে বার্নার্ড শ’র সঙ্গে তাঁর কিছুটা সাদৃশ্য চোখে পড়ে। সাহিত্যে ভাবপ্রবণতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তিনি নতুনতর জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করেন। আসলে রোমান্টিক ভাব বর্জিত কঠিন কঠোর বাস্তবের রূপকার ছিলেন মানিক। কোনরূপ মুখশের আড়ালে গা ঢাকা দেওয়ার মত শিল্পী তিনি ছিলেন না। বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ার কারণে তাঁর মধ্যে গড়ে উঠেছিল বৈজ্ঞানিকের নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি। সেই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই তিনি জীবনকে বিশ্লেষণ করেছেন। প্রকৃত বৈজ্ঞানিকের মতই তিনি নিরাসক্ত দ্রিষ্টিতে সমাজকে দেখেছেন; তাই তাঁর সাহিত্যে জীবনের প্রতি আসক্তি ও নিরাসক্তির সুন্দর সমন্বয় সাধিত হয়েছে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (Manik Bandopadhyay) তাঁর গল্প মানুষকে দেহজীবি মানুষরূপেই দেখেছেন; তার কামনা, বাসনা, সমাজ জীবন প্রভৃতিকে তিনি সূক্ষ্ম ভাবরসে নিমজ্জিত করতে চান নি। তারাশঙ্কর যেমন মাটির মানুষকে আরও একটা বৃহত্তর সত্ত্বার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন, মাণিক বন্দ্যপাধ্যায়ের সে রকম কোন দার্শনিক প্রবণতা বা আদর্শবাদ ছিল না।
ফ্রয়েডের মনোবিকলন ও মনোবিকার তত্ত্বের দ্বারা তিনি গভীর ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। “বঙ্গশ্রী” পত্রিকায় চাকরি করার সময় তিনি মার্ক্সীয় দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হন | বুখানিনের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ আর লিয়নটিয়েভের লেখা থেকে মার্ক্সীয় দর্শনের অর্থনীতি সম্বন্ধে জ্ঞান আহরণ করে নিজেকে মার্ক্সীয় নীতিতে বিশ্বাসী সাহিত্যিক রূপে প্রতিষ্ঠা করেন | ফলে তাঁর রচনা দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে --- প্রথম পর্বে দেখা যায় ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের প্রতি ঝোঁক, দ্বিতীয় পর্বে মার্ক্সীয় দর্শনের প্রভাব।
পরিশেষে নিজের সম্বন্ধে লেখকের একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করা যেতে পারে। - “ভাবপ্রবণতার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিক্ষোভ সাহিত্যে আমাকে বাস্তবকে অবলম্বন করতে বাধ্য করেছিল। কোন সুনির্দিষ্ট জীবনাদর্শ দিতে পারি নি। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে বাস্তবতার অভাব খানিকটা মিটিয়েছি নিশ্চয়ই”।
Post a Comment