Poet Ishwar Chandra Gupta : ঈশ্বরগুপ্তের কবিতার প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট

ঈশ্বরগুপ্তের কবিতার প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট গুলি উল্লেখ করে তাঁকে যুগসন্ধিক্ষনের কবি বলা যায় কিনা বিচার কর ।


ঈশ্বরগুপ্ত






উত্তর- বাংলাসাহিত্যে আধুনিক যুগের সূত্রপাত হয় উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকে। এই যুগের প্রথম কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (poet Ishwar Chandra Gupta) (১৮১২-৫৯)। মধ্যযুগের সর্বশেষ কবি রায়গুনাকর ভারতচন্দ্রের মৃত্যু হয় ১৬৭০ খ্রীষ্টাব্দে, আবার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে আধুনিক যুগের রূপ ফুটে উঠে মাইকেল মধুসূদন দত্তের কাব্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। এ সময়টি শুরু হয় মোটামুটিভাবে ১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে। মধ্যযুগের অবসান এবং আধুনিক যুগের সূচনা এই দুই যুগের মধ্যবর্তী সময়টাতে বাংলা কাব্যের ক্ষেত্রে তেমন কোন উৎকর্ষপূর্ণ সৃষ্টি বা সৃষ্টি সম্ভারের প্রাচুর্য দেখা যায় না। এই সময়টা বাংলা গদ্যের উদ্ভবকাল। গদ্য তখনও সাহিত্যের যথার্থ বাহনের উপযোগিতা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। এই সময়ের সামগ্রিক বাংলা সাহিত্যেই বিরাজমান ছিল যুগ সন্ধির বৈশিষ্ট্য। ঈশ্বর গুপ্তের কবি প্রতিভার বিকাশ ঘটেছিল এই সময়ে। তাই বাংলা সাহিত্যে তিনি যুগসন্ধিক্ষণের কবি হিসেবে পরিচিত।


এই সময়ে বাংলা কাব্য সাহিত্যে ঈশ্বর গুপ্ত ছাড়া আর কারো বৈচিত্রপূর্ণ রচনাসম্ভার দেখা যায় না। বাংলা সাহিত্যের মধ্য ও আধুনিক যুগের সন্ধিস্থলে দাঁড়িয়ে সব্যসাচীর মত দুহাতে দুদিকের নির্দেশ দিয়েছেন কবি ঈশ্বর গুপ্ত। এই সময়ের একমাত্র খ্যাতিমান কবি তিনি। অর্থাৎ মধ্যযুগের অবসানের পর এবং আধুনিক যুগের প্রকৃত সূত্রপাতের পূর্বে কবি ঈশ্বর গুপ্ত কাব্য সাধনায় খ্যাতিলাভ করেন। তার সাহিত্যসাধনার সূত্রপাত হয় ১৮৩১ সাল থেকে ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে। তিনি ছিলেন পত্রিকাটির সম্পাদক ও প্রধান লেখক।


ঈশ্বর গুপ্ত কবি হিসেবেই পরিচিত। তার কবিতার সংখ্যা যেমন অগণিত, তেমনি বিষয়ের বৈচিত্রও কম নয়। বঙ্কিমচন্দ্র ঈশ্বর গুপ্তের কবিতাগুলোকে বিষয়ানুযায়ী কয়টি ভাগে বিভক্ত করেছিলেনঃ ‘পারমার্থিক ও নৈতিক বিষয়ক কবিতা’ ‘সামাজিক ও ব্যঙ্গপ্রধান কবিতা’, ‘রসাত্মক কবিতা’ ‘যুদ্ধ বিষয়ক কবিতা’. ঋতুবর্ণনা প্রধান কবিতা’ ‘বিবিধ বিষয়ক কবিতা’, ‘শকুন্তলার কাহিনী নিয়ে রচিত কবিতা’, ‘সারদা-মঙ্গল বা উমা-মেনকার প্রসঙ্গে কবিতা’ ‘কাব্যকানন’, ‘রসলহরী’ ও ‘কবিতাগুচ্ছ’।সামাজিক ও ব্যঙ্গকবিতাগুলোর জন্য ঈশ্বরগুপ্তের সর্বাধিক খ্যাতি। তার রঙ্গরসপ্রবণতা ও লঘু চপলভঙ্গি কবিতাগুলোকে উৎকর্ষ দান করেছে। সে আমলে ইংরেজি শিক্ষাসভ্যতার সংস্পর্শে বাঙালির সমাজ ও জীবনে যে বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল ঈশ্বরগুপ্ত তাকে কবিতার উপজীব্য করেছেন। যেখানেই সামাজিক অনাচার, চারিত্রিক দৈন্য ও আদর্শহীনতা দেখেছেন সেখানেই তীব্র ব্যঙ্গ করেছেন। এ ব্যাপারে তিনি প্রাচীন-নবীনের কোন পার্থক্য করেননি। তাঁর সমাজসংক্রান্ত কবিতার বিষয়বস্তু ও ছিল বৈচিত্রপূর্ণ। যেমনঃ বিধবাবিবাহ আন্দোলনের বিরোধিতা, কৌলীন্যপ্রথার অপকারিতা, খ্রিষ্টধর্মের ব্যাপক প্রসারে আশঙ্কা, বাঙালির সাহেবিয়ানা- অনুকরণ-প্রিয়তা এবং দেশীয় আচারপ্রথা ও গুরুপুরোহিতে অবজ্ঞার জন্য ক্ষোভ, স্ত্রীশিক্ষার প্রসারে সমাজে বিকৃতি ও প্রাচীন সনাতন স্ত্রীধর্ম লোপের আশঙ্কা, দেশে ব্যাপক গোহত্যা এবং সে কারণে দুগ্ধাভাব, স্নানযাত্রা উপলক্ষে জমিদারের অনাচার-ব্যভিচারের বর্ণনা, খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষ, বাঙালিদের প্রতি সাহেবদের উপেক্ষা, ইয়ং বেঙ্গলদের ক্রিয়াকলাপে অশ্রদ্ধা, নীলকর সাহেবদের অত্যাচার- অবিচার। এসব বিষয় থেকে প্রমাণিত হয় যে ঈশ্বর গুপ্ত যুগের পরিবর্তনকে মেনে নেননি।ঈশ্বরগুপ্ত ব্যঙ্গকবিতার জন্য যে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তার গুরুত্ব ছিল সুদূরপ্রসারী। কবিওয়ালাদের জন্য সখীসংবাদ লিখে সমকালে তিনি খ্যাতিমান হয়েছিলেন। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ব্যঙ্গ করে তিনি যে প্রতিভার পরিচয় দিয়ে গেছেন তাই তার নাম বাংলা সাহিত্যে উজ্জ্বল করেছে। প্রাচীন কবিগণের জীবনী সংগ্রহ করে তিনি যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন তার গুরুত্বও কম নয়।ইংরেজদের আচার আচরণকে এ দেশের জন্য অকল্যাণকর মনে করে ইংরেজিয়ানা প্রীতির ব্যঙ্গ করেছেন ‘ইংরেজি নববর্ষ’ কবিতায়ঃ




‘ধন্যরে বোতলবাসি ধন্য লাল জল।
ধন্য ধন্য বিলাতের সভ্যতার ফল॥’


তাঁর ‘বাঙালির মেয়ে’ কবিতায়ও অতীতমুখীনতার পরিচয় পাওয়া যায়। স্ত্রীশিক্ষার প্রতি তাঁর সমর্থন ছিল না বলে তিনি লিখেছিলেন-






লক্ষ্মী মেয়ে যারা ছিল,
তারাই এখন চড়বে ঘোড়া চড়বে ঘোড়া।
ঠাট ঠমকে চালাক চতুর
সভ্য হবে থোড়া থোড়া॥


**************
(এরা) আপন হাতে হাঁকিয়ে বগী,
গড়ের মাঠে হাওয়া খাবে।






জীবনকে হালকাভাবে দেখার একটা বিশেষ দৃষ্টি ঈশ্বর গুপ্তের ছিল বলেই নানা বিষয়ে তিনি রঙ্গরসের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তিনি সমগ্র বিশ্বকে কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টিতে দেখেছিলেন বলে তাঁর রচনায় সূক্ষ্মতা বা গভীরতা ছিল না। তাই তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়, ‘ঈশ্বর গুপ্ত সমসাময়িক ঘটনার কবি, লৌকিক আচার ও সামাজিক পরিচিতিরি কবি, গভীর জীবনবোধের কবি নন।’ এই প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের মন্তব্যও উল্লেখযোগ্য। তিনি লিখেছেন, ‘ঈশ্বর গুপ্তের কাব্য চালের কাঁটায়, রান্নাঘরের ধূয়ায়, নাটুরে মাঝির ধ্বজির ঠেলায়, নীলের দাদনে, হোটেলের খানায়, পাঁঠার অস্থিস্থিত মজ্জায়। তিনি আনারসে মধুর রস ছাড়া কাব্যরস পান, তপসে মাছে মৎস্যভাব ছাড়া তপস্বীভাব দেখেন, পাঁঠার বোকা গন্ধ ছাড়া একটু দধীচির গায়ের গন্ধ পান।’


ঈশ্বর গুপ্তের কবিতায় প্রাচীন ও নবীন দুই যুগের বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ ঘটেছিল। তিনি যুগের পরিবর্তনকে গ্রহণ করতে পারেননি বলে প্রাচীন পন্থীর প্রমাণ মিলে। ইংরেজি শিক্ষাসংস্কৃতির প্রতি বিরূপতা তাঁকে এই বৈশিষ্ট্য দান করেছে। কবিওয়ালাদের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন বলে তাঁর কাব্যে সে ধরনের বৈশিষ্ট্য ও প্রকাশমান। তাঁর রঙ্গব্যঙ্গপ্রবণতা, কৌতুকরসসৃষ্টির দিকে বিশেষ ঝোঁক, অনুপ্রাস যমকের আতিশয্যে চমক লাগানোর প্রয়াস, উচ্চকণ্ঠ হাসিহল্লা- এ সবই কবিওয়ালাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগের প্রমাণ। বাঙালির অন্তঃপুরের বিবিধ ভোজ্যদ্রব্য নিয়ে ঈশ্চর গুপ্ত সে সব কবিতা রচনা করেছেন তাও কবিওয়ালাদের প্রভাবজনিত। তবে তিনি কবিওয়ালাদের অসংলগ্ন ও শিল্পবোধহীন রচনারীতি অতিক্রম করে উন্নত বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।


তবে আধুনিক যুগের বৈশিষ্ট্যও তাঁর মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। সমাজ সচেতনতা তাঁর কাব্যেই প্রথমবারের মত ফুটে ওঠে। তিনি সমসাময়িক ঘটনা অবলম্বনে অনেক ব্যঙ্গকবিতা রচনা করেছেন। ইংরেজি শিক্ষা ও সভ্যতার প্রভাবে শিক্ষিত বাঙালি সমাজে যে উচ্ছৃঙ্খলতার প্রকাশ ঘটেছিল তিনি সে সম্পর্কে ব্যঙ্গবিদ্রপাত্মক কবিতা লিখেছেন। সমাজের এই অসংগতি তার কাব্যের উপজীব্য। বাংলা সাহিত্যে তিনিই প্রথম পরিবেশ সচেতন কবি। চারদিকের জীবন তার দৃষ্টিতে কৌতুকের উপাদেয় উপকরণ হিসেব ধরা পড়েছিল। তা নিয়ে তিনি ব্যঙ্গ করেছেন এবং সে ক্ষেত্রে তার মৌলিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। নৈতিকতা, দেশপ্রেম, সমাজসেবা প্রভৃতি বিষয় অবলম্বনেও ঈশ্বর গুপ্ত ব্যঙ্গকবিতা রচনা করেছেন। বস্তুতপক্ষে, সামাজিক বিষয়বস্তু অবলম্বনে রচিত কবিতাগুলোর মাধ্যমেই তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত। পাশ্চাত্য ধ্যানধারণার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। সাংবাদিক হিসেবেও তিনি সমসাময়িক চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। এদিক থেকে তিনি আধুনিকতার অনুসারী।


এদিক থেকে ঈশ্বর গুপ্তকে বাংলা সাহিত্যের ‘জেনাস’ বলা যায়। গ্রীক দেবতা ‘জেনাস’ (যার নাম হতে জানুয়ারী মাসের উৎপত্তি) এর দুটি মুখের একটি গত দিনের দিকে অন্যটি অনাগত দিনের দিকে। ইশ্বরগুপ্তও বাংলা সাহিত্য যুগসন্ধিস্থলে দাঁড়িয়ে দুটি যুগকে এক সূত্রে গ্রথিত করে আছেন। তার এক মুখ অতীতে অপর মুখ অনাগত ভবিষ্যতের দিকে। তাই তার কাব্যে একদিকে পুরাতন অনুকরণ অপর দিকে আধুনিক নতুন ধারার ইঙ্গিতও রয়েছে।

0/Post a Comment/Comments