Raja Ram Mohan Roy - রাজা রামমোহন রায়-বাংলা গদ্য
উত্তর- উনবিংশ শতাব্দীর পূর্বে সাহিত্য নাম দেয়া যায় বাংলা সাহিত্যে তেমন কোন গদ্য ছিলনা, যা ছিল তা দলিল দস্তাবেজ, চিঠিপত্র, বৈষ্ণবদের গদ্যপদ্য রচিত কড়চায় এবং কচিৎ দু’একটি উৎকর্ণ লিপিতে। এছাড়া সপ্তদশ শতকের শুরু থেকেই পর্তুগীজ পাদরিরা মধ্য ও পূর্ববঙ্গে যেভাবে খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের প্রচেষ্টা শুরু করেন তাতেও বাংলা গদ্যের পথ কিছুটা সুগম হয়। এরপর রামকৃষ্ণ মিশনারীদের ধর্মপ্রচার এবং ইংরেজ মিডিলিয়ানদের বাংলা প্রশিক্ষণের জন্যে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের হাতে বাংলা গদ্যের প্রচলন বাংলা গদ্যের বিকাশকে আরও ত্বরান্বিত করে। এর ফলে ওই সময়ে যারা বাংলা গদ্য নিয়ে সাহিত্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেন তাদের মধ্যে রাজা রামমোহন রায় (Raja Ram Mohan Roy)শ্রেষ্ঠ গদ্যশিল্পী হিসেবে স্বমর্যাদার আসনে অধিষ্টিত হন।
পৃথিবীর বহু দেশের ভাষায় পারদর্শী রাজা রামমোহন রায় (Raja Ram Mohan Roy) আরবি ফারসি বাংলা সংস্কৃত ও ইংরেজিতে অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। শুধু বাংলায়ই তিনি ত্রিশ খানি গ্রন্থ রচনা করেছেন, তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেঃ বেদান্ত গ্রন্থ (১৮১৫), বেদান্ত সার (১৮১৫), ভট্টাচার্যের সহিত বিচার (১৮১৭), গোস্বামীর সহিত বিচার (১৮১৮), প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ (১৮১৯), পথ্যপ্রদান (১৮২৩) ইত্যাদি।
এছাড়া তিনি কয়েকটি ব্রাহ্মসংগীত এবং গৌড়ীয় ব্যাকরণ নামে ইংরেজিতে লেখা একটি বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন। রাজা রামমোহন রায় (Raja Ram Mohan Roy) ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে ‘ব্রাহ্মণসেবধি’ নামে বাংলায় এবং ‘নৎধযসঁহরপধষ সধমধুরহব’ নামে ইংরেজিতে এবং তার পরের বছর ‘মীরাতুল আখবার’ নামে ফারসিতে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। রামমোহনের বেশ কয়েকটি ইংরেজি গ্রন্থ বিলাত থেকেও প্রকাশিত হয়েছিল।
রায়। বাংলা রচনায় রামমোহন রায় (Raja Ram Mohan Roy) যে গদ্য রীতির ব্যবহার করেছেন তাতে তিনি কোনপ্রকার স্টাইলের ধার ধারেননি। বাংলা গদ্যে যে যুগে প্রাঞ্জলতা ছিল অতি দুর্লভ, সে সময়ে তিনি প্রাঞ্জল ভাষা রীতির ব্যবহারে সার্থকতার পরিচয় দিয়েছেন। বাঙালির জাতীয় জীবনে যখন অমানিশার ঘনঘটা তখন এর অবসান ঘটিয়ে মুক্তির দূত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন রামমোহন রায় (Raja Ram Mohan Roy)।
বিচিত্রমুখী প্রতিভার অধিকারী রাজা রামমোহন রায় (Raja Ram Mohan Roy) সংস্কারের গন্ডিতে আটকে থাকা বাঙালিকে মুক্ত করে সন্ধান দিয়েছেন নতুন পথের। নিজেদের অতীত ঐতিহ্যের ধারার যোগসূত্র হারিয়ে এবং পাশ্চাত্যের মহৎ চিন্তাধারার সংগে নিজেদের মিলিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়ে বাঙালি জাতি যখন দেউলিয়া হতে বসেছিল ঠিক সে সময়ে জাতির প্রাণে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার করেছিলেন এই রাজা রামমোহন রায়। বিশেষ প্রয়োজন সাধনের লক্ষ্যে ব্যবহৃত তার গদ্যরীতিতে সাহিত্যের প্রভাব ছিল বটে কিন্তু তাতে বক্তব্য প্রকাশের সার্থকতর উপযোগিতাও ছিল লক্ষ্য করার মত। সুতরাং এ কথা নির্দিধায় বলা যায় যে,তাঁর ব্যবহৃত গদ্যরীতি পুরোপুরি সাহিত্যরসমণ্ডিত না হলেও কার্যোপযোগিতা থাকায় তা হয়ে উঠেছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
তাঁর (Raja Ram Mohan Roy) ভাষারীতির সমালোচনা করতে গিয়ে কবি ইশ্বর গুপ্ত মন্তব্য করেছেন, ‘দেওয়ানজী জলের ন্যায় সহজ ভাষা লিখিতেন, তাহাতে কোন বিচার ও বিবাদঘটিত বিষয় লেখায় মনের অভিপ্রায় ও ভাব সকল অতি সহজে স্পষ্টরূপে প্রকাশ পাইত, এজন্য পঠকেরা অনায়াসেই হৃদয়ঙ্গম করিতেন, কিন্তু সে লেখায় শব্দের বিশেষ পারিপাট্য ও তাদৃশ মিষ্টতা ছিল না।’
রাজা রামমোহন রায় (Raja Ram Mohan Roy) তাঁর রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে যুক্তি এবং তর্ক উপস্থাপনের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে নিজস্ব মতবাদকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ‘বেদান্ত গ্রন্থ’ ও ‘বেদান্তসার’ প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থের অনুবাদ হওয়া সত্ত্বেও রামমোহন রায় যথাসাধ্য সহজ ও সরল ভাষায় উপস্থাপন করেছেন পাঠকের সামনে। আর এই পথ অনুসরণ করেই বাংলা ভাষার আত্মপ্রকাশের পথ সুগম হয়।
এখানে ‘ব্রাহ্মণ সেবধি’ গ্রন্থ থেকে রামমোহন রায়ের ভাষার কিছু নিদর্শন উদ্ধৃত করা হলোঃ
‘শতার্ধ বৎসর হইতে অধিককাল এদেশে ইংরেজের অধিকার হইয়াছে তাহাতে প্রথম ৩০ বৎসর তাহাদের বাক্য ও ব্যবহরের দ্বারা ইহা সর্বত্র বিখ্যাত ছিল যে, তাঁহাদের নিয়ম এই যে কাহারও ধর্মের সহিত বিপক্ষতাচরণ করেন না...’
এই ভাষা থেকে পরিস্কার প্রতীয়মান হয় যে রাজা রামমোহন রায় (Raja Ram Mohan Roy) বাংলা ভাষার বিশেষ করে বাংলা গদ্যের অর্ন্তনিহিত দুর্বলতা উপলব্ধি করেছিলেন, কিন্তু এই দুর্বলতা দূরীকরণে যেরূপ সংস্কার সাধন প্রয়োজন সে ধরনের সংস্কার করতে সক্ষম হননি। কারণ তাঁর ভাষা সরল প্রাঞ্জল ও সহজবোধ্য হলেও সাহিত্য রসমণ্ডিত না হওয়ায় তা শিল্প হয়ে উঠেনি। তবে ব্রাহ্ম সংগীতগুলোতে রামমোহন রায়ের যে মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায় তার মূল্য একেবারে কম নয়।
এখানে রামমোহনের (Raja Ram Mohan Roy) একটি গানের উদ্ধৃতি দেয়া হলোঃ
‘কি স্বদেশে কি বিদেশে
যথায় তথায় থাকি।
তোমার রচনা মধ্যে
তোমারে দেখিয়া ডাকি।’
হতাশ বাঙালির হৃদয় দুয়ারে তিনি এসেছিলেন আশার আলোকবর্তিকা হয়ে। তমসাচ্ছন্ন বাংলা ভাষাকে মুক্ত করতে অন্ধকার অতল গহ্বর থেকে এবং সক্ষমতার সাথে তা করলেন।
বাংলা গদ্যের মুক্তির দূত রাজা রামমোহন রায় (Raja Ram Mohan Roy) সম্পর্কে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেনঃ ‘rammohan roy inaugurated the modern age in india. Rammohan was the only person in his time in the whole world of man to realise completely the significance of modern age.’বর্তমান কালের পরিপ্রেক্ষিতে রাজা রামমোহন রায়ের রচনা বিসদৃশ মনে হলেও তৎকালীন বাংলা সাহিত্যের আঙ্গনে গদ্য রীতিতে তিনি ছিলেন সর্বোচ্চ স্থানের অধিকারী।
[বিভিন্ন বাংলা সাহিত্য বিষয়ক গ্রন্থ থেকে এটি সম্পাদনা করা হয়েছে, ছাত্রছাত্রীদের জন্য । এই লেখা আমাদের নিজস্ব লেখা নয়, সংগৃহীত ।]
Post a Comment